একটি পরিত্যক্ত চায়ের কাপ

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এ একটা টার্ম আছে, লুজলি কাপলড। এর মানে হলো, দুইটা সফটওয়্যার কম্পোনেন্ট একটা আরেকটার সাথে খুব একটা নির্ভর করে থাকবে না। নিজেরা স্বাধীনভাবে চলতে পারবে, দরকার হলে একে অপরের সাহায্য নিতে পারবে, কিন্তু কেও কারো উপর খুব বেশি নির্ভর করবে না। আমার বন্ধু সফিক, তার ধারণা মানুষের সম্পর্কগুলোও হওয়া উচিৎ লুজলি কাপলড। এতে করে সমস্যা কমে। কেও কারও উপর পুরাপুরি নির্ভর করে বসে থাকলে অনেক সমস্যা। যেমন সে ইচ্ছে করলেই যা খুশি করতে পারবে না, তার কোন কাজের জন্য যে তার উপর নির্ভর করে বসে থাকবে তার উপর তার প্রভাব পরবে।

শফিক আমার ছোট বেলার বন্ধু। এখন অবশ্য অনেক ব্যস্ত থাকে বলে তার সাথে যোগাযোগ হয় না, কিন্তু শফিকের মা, আন্টি আমাকে অত্যধিক স্নেহ করে বলে সেই লোভে মাঝে মাঝে ওর বাড়িতে যাই। হয়তবা দেখা যায়, শফিকের সাথে দেখায় হয় না, আন্টির সাথে কথা বলে চলে আসি। শফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বসে আছে দু-বছর হলো। বসে আছে বলতে চাকরি বাকরি করছে না। তো একদিন ওর বাসায় গেলাম। আন্টির সাথে এই কথা সেই কথা বলতে বলতে শফিকের কথা আসলো। আন্টির ইচ্ছে শফিককে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া, কিন্তু শফিক কোন ভাবেই রাজি না। আমাকে বললেন, আমি যেন তাকে রাজি করাই। আমি জানি যে মহান দায়িত্ব আন্টি আমাকে দিলেন, তার একটুও আমাকে দিয়ে হবে না, কারণ আমি শফিককে রাজি করাতে পারবো না। ওর মহান মহান ফিলোসফি দিয়ে আমাকে এতো বেশি বোর করে ফেলবে যে, আমি আর ওর সামনে বসে থাকার সাহস দেখাবো না। তবুও আন্টির কথা মতো ওর সাথে দেখা করতে গেলাম। শফিকের দুইটা ঘর, একটিতে ঘুমায়, অন্যটিকে তার ল্যাব রুম বানিয়েছে। এইটাকে ল্যাব রুম না বলে স্টোর হাউজ বললে খুব একটা মিথ্যা বলা হবে না। রুমে অসংখ্য ইলেক্ট্রিক যন্ত্রপাতি, ক্যাবল, বই এ ঠাসা, রাজ্যের জিনিসপত্র। দুই তিনটা খুলা সিপিইউ।

ওর রুমে ঢুকলাম।

শফিক মনিটরের স্ক্রিন এ দিকে তাকিয়ে আছে, আর কি যেন টাইপ করছে, তিনটা স্ক্রিনে নানা রকম টেক্সট। এগুলো আমি বুঝি না। শুধু বুঝলাম, জটিল কোন প্রোগ্রামিং করছে সে। মেঝেতে ইলেকট্রিক ফ্লাক্স, কম্পিউটার টেবিলে তিনটা কাপ, দেখে মনে হবে এগুলো এখনি শেষ করা হয়েছে।

আমি গিয়ে গলা খাঁকারি দিলাম। কিন্তু ও বুঝল না। ও ওর মতো কাজ করে যাচ্ছে, আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে যখন দেখলাম এইভাবে কাজ হবে না, তখন ওর পিঠে হাত দিলাম। মোটা চশমার পরে আছে সে, আমার দিকে তাকাল-

‘ও তুই কখন এসেছিস?’

‘অনেকক্ষণ, এইখানে দাড়িয়ে কি করছিস দেখছিলাম।’

‘ও, জটিল একটা কাজ করছি, আচ্ছা বোস।’

ও আমাকে বসতে বলল, কিন্তু কোথায় বসবো বুঝলাম না, ওর রুমে আর কোন চেয়ার নেই। আমি এদিক ওদিক তাকাতেই বলল, – ‘ আমার রুমে গিয়ে বোস, এই রুমে চেয়ার ইচ্ছে করেই রাখি না, কেও এসে বসে থাকলে আমার কাজের ডিসটার্ব হয়।’

আমি ওর রুমে গেলাম। এই রুমে মানুষ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। বিছানা এতো অগাছালো, দেখে মনে হবে, ইচ্ছে করেই সে অগোছালো হয়ে থাকে। বিছানা ভর্তি বই আর বই, এর অনেকগুলাই খুলা। তবুও বসলাম। বই গুলার মাথামন্ড কিছু বুঝলাম না। আমার বুঝার কথা না, সবই টেকনিক্যাল বই। বসে থেকে বইগুলা নাড়াচাড়া করতেছিলাম। কতক্ষণ বসে থাকা যায়, তারপর আবার ওর ল্যাবে এলাম,

‘শফিক তোর সাথে একটু কথা ছিল, একটু আয়।’

‘কি কথা বুঝছি, মা পাঠিয়েছে তো, আচ্ছা পাঁচ মিনিট বোস,আসতেছি।’

আবার বসলাম,ওর পাঁচ মিনিট কতক্ষণে শেষ হয়, কে জানে।

আমি আরও প্রায় কুড়ি মিনিট বসে আবার ল্যাব এ এলাম।

‘শফিক!’

‘দোস্ত সরি, একটা ইন্টারেস্টিং কাজ করছিলাম। একটা গেইম লিখেছিলাম, সাইন্স-ক্রাফট। মজার একটা গেইম, তোর তো আইফোন নাই, তাহলে তোরে দিতে পারতাম। গেমটা শুরু হয় এইভাবে, মনে কর, তুই আদিম মানুষ, তোকে ধীরে ধীরে আধুনিক হতে হবে। তোকে জংগলে ছেড়ে দেওয়া হবে, এর পর তুই নানা রকম টেকনোলজি আবিষ্কার করে করে বর্তমানে চলে আসবি। বর্তমানে এলেই গেইম ওভার। অলরেডি দশ লক্ষ্য কপি ডাউনলোড হয়ে গেছে। একটা খুব ক্রিটিক্যাল বাগ রিমুব করলাম।’

আমার গেমিং এ কোন ইন্টারেস্ট নেই, তাই কিছু বললাম না।

‘এখন বল কি বলবি।’

‘এমনি কথা বলতে আসছি, তোর সাথে কতদিন দেখা-সাক্ষাৎ না।’

‘তুই তো আমাদের বাসায় আসিস, মার সাথে দেখা করে চআসিসলে যাস, আমার সাথে কথা বলতে আসিস না’

কথা সত্য, কিন্তু এই পাগলের সাথে কথা বলতে কে আসতে চায়।

‘তো এখন কি করছিস, চাকরি বাকরি কিছু করবি?’

‘না, চাকরি দিয়ে কি করবো, এমনিতেই আমার ভাল ইনকাম হচ্ছে, মাসে মোটামুটি ১৫০০-২০০০ ডলার আসে, পুরোটাই তো জমে যাচ্ছে, বাপের হোটেলে বসে বসে খাচ্ছি।’

আমি কথা বলার সুযোগ পেলাম, ‘আর কতদিন এইভাবে চলবে, এইবার বিয়ে-সাধি কর। আমরা একটু পেট পুরে ভুড়িভোজ করি।’

‘বুঝছি, মা তরে এইগুলা বলতে পাঠাইছে, বিয়ে করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু মার জালাতনে আর পারছি না, প্রতিদিনই এক প্যাঁচাল, তার নাতির মুখ দেখেতে ইচ্ছে করে, কি যে করি।’

‘ঠিক ই তো আছে, বিয়ে করতে হবে না, তাছাড়া আন্টিরও তো সখ আহ্লাদ আছে, নাতিদের নিয়ে উনি ফুর্তি করবে।’

‘তো আন্টিকে খুশি করতে গেলে তো আমার বারটা বেজে যায়, শোন বিয়ে যখন করতেই হবে, সুতরাং তোকে বলে রাখি, আমাদের রিলেশান হবে লুজলি কাপলড। লুজলি কাপলড মানে বুঝছি, আমাদের মধ্যে কোন ডিপেন্ডেন্সি থাকবে না। ও ওর মতো চলবে, আমি আমার মতো, কেও কাওকে ডিস্টার্ব করবো না। মোস্ট ইম্পির্ট্যান্টলি একটা মিউট বাটন থাকতে হবে, আমি বেশি কথা বলতে পারবো না, ফোনে তো নয়ই, আমি অনেক ব্যস্ত থাকি, সুতরাং কাজের সময় আমাকে যন্ত্রণা করা যাবে না। এইরকম কাওকে পেলে জানা। এখন বিদায় হ।’

আমি চলে আসলাম সেদিন। তারপর অনেকদিন তার সাথে দেখা হয় না, আমি জানি না, সে তার লুজলি কাপলড বিয়ে করতে পেরেছিল কিনা জানি না। একদিন হঠাৎ করেই গেলাম দেখা করতে, শুনেছি কিছুদিন হলো ও বিয়ে করেছে। প্রথমেই তার ল্যাব এ গেলাম, আমি জানি, তাকে এইখানেই পাওয়া যাবে।

কিন্তু এবার গিয়ে অবাক হলাম। তার ল্যাব এর বাকি দুইটা কম্পিউটার সুইচড-অফ। একটি অন করা কিন্তু তাতে স্ক্রিন সেভার চলছে। পাশে এক-কাপ চা, সেটি বোধহয় দু-এক চুমুক  দেওয়া হয়েছিল। রুমের অবস্থা আগের মতো নেই, বরং বেশ পরিপাটি।

পাশের রুমের দরজাটি লাগানো।

6 thoughts on “একটি পরিত্যক্ত চায়ের কাপ

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান